বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; মোহাম্মদ ফারিস লিখিত বই প্রোডাক্টিভ মুসলিম এর pdf ফাইল ডাউনলোড করতে নিচে দেওয়া DOWNLOAD বাটনে ক্লিক করুন।
প্রোডাক্টিভিটির পরিচয়
সহজ করে বলতে গেলে প্রোডাক্টিভিটি হচ্ছে আউটপুট ভাগ ইনপুট। কিছু বিনিয়োগ করে যতটুকু ফলন অথবা লাভ পাওয়া যায়, তাই প্রোডাক্টিভিটি। স্বাভাবিকভাবে ছয় ঘণ্টার কাজ যদি আপনি তিন ঘণ্টায় সম্পন্ন করতে পারেন, তাহলে আপনি প্রোডাক্টিভ। অর্থাৎ অল্প সময়ে অনেক কিছু করে ফেলা। আমি প্রোডাক্টিভিটিকে ঠিক এভাবে বর্ণনা দিই-
প্রোডাক্টিভিটি = মনোযোগ x শারীরিক কর্মক্ষমতা x সময়
প্রোডাক্টিভ মানুষ হতে আপনার মধ্যে তিনটি জিনিস থাকতে হবে -মনোযোগ, শারীরিক কর্মক্ষমতা ও সময়। আপনার যদি মনোযোগ আর সময় দুটোই থাকে, কিন্তু শরীরে কাজ করার মতো শক্তি কিংবা কর্মক্ষমতা না থাকে, তাহলে অল্প সময়েই ক্লান্ত এবং কাজে অলস হয়ে পড়বেন। আবার যদি আপনার শারীরিক কর্মক্ষমতা এবং সময় দুটোই থাকে, কিন্তু মনোযোগের অভাব থাকে, তাহলে অতি সহজে এক কাজ থেকে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। এতে করে আপনি কোনো কাজই সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন না। আবার যদি শারীরিক কর্মক্ষমতা এবং মনোযোগ দুটোই থাকে, কিন্তু এগুলোকে কাজে লাগানোর মতো যথেষ্ট সময় না থাকে, তাহলেও কোনো কাজই করতে পারবেন না। ফলে আপনি কখনোই প্রোডাক্টিভ হতে পারবেন না।
কেন সার্বক্ষণিক প্রোডাক্টিভ হতে পারছেন না, প্রোডাক্টিভিটির সংজ্ঞা আপনাকে তা বুঝিয়ে দেবে। নিজেকে শুধু একটি প্রশ্ন করতে হবে- ‘আমি কি অলস, বিক্ষিপ্ত চিন্তার মানুষ, নাকি তাড়াহুড়োপ্রবণ?’ এই প্রশ্নের উত্তরই বলে দেবে- কীসের অভাবে আপনি কাজে প্রোডাক্টিভ হতে পারছেন না। এই প্রশ্নের উত্তরই বলে দেবে, প্রোডাক্টিভিটির কোন উপাদান নিয়ে আপনাকে কাজ করতে হবে; মনোযোগ? শারীরিক কর্মক্ষমতা? নাকি সময়?
পুরো বইটিতেই দৈনন্দিন জীবনে প্রোডাক্টিভ হওয়ার জন্য মনোযোগ, শারীরিক কর্মক্ষমতা এবং সময়ের সঠিক প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, কীভাবে ইসলাম এই তিনটি দিকের সংমিশ্রণ করে আমাদের প্রোডাক্টিভ মুসলিম হতে সাহায্য করে ।
তবে এখানে একটি কথা আছে
আপনি একজন ভিডিও গেম খেলোয়ারের কথা চিন্তা করুন। দেখবেন, গেমের ওপর তার পুরো মনোযোগ। হয়তো তিনি শারীরিকভাবেও যথেষ্ট কর্মক্ষম এবং বলতে গেলে অফুরন্ত সময়ও রয়েছে। এখন এই খেলোয়ারকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? আপনি কি বলতে পারবেন, তিনি প্রকৃত প্রোডাক্টিভ মানুষ? অবশ্যই নয়। এখানেই আমি আমার প্রোডাক্টিভিটির সংজ্ঞাতে একটু ভিন্ন কিছু যোগ করছি। প্রোডাক্টিভিটি= মনোযোগ x শারীরিক কর্মক্ষমতা x সময় ( অবশ্যই একটি লাভজনক উদ্দেশ্যে)।
প্রোডাক্টিভিটি অর্থ : একটি লাভজনক ফলাফলের নিমিত্তে নিজের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে মনোযোগ, শারীরিক কর্মক্ষমতা এবং সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।
প্রোডাক্টিভিটি নিয়ে আমাদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা কখনো কখনো কোনো কিছু বুঝতে তার উলটো অর্থ জানতে হয়। এতে তা সহজেই বোঝা যায়। এক্ষেত্রে প্রোডাক্টিভিটি নিয়ে আমাদের মধ্যে চারটি ভ্রান্ত ধারণা বুঝতে চেষ্টা করব।
১. ব্যস্ততা মানেই প্রোডাক্টিভিটি নয়
আপনি সারাদিন ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও নন-প্রোডাক্টিভ হতে পারেন। ভাবছেন, এটা কোনো কথা হলো? কীভাবে? মিটিং, ফোনকল, ই-মেইল-এ আপনার মূল্যবান সময়, মনোযোগ ও শক্তি নষ্ট করলেই যে প্রোডাক্টিভ হওয়া যায়, তা নয়। এই কাজগুলো আপনার জীবনের মান বাড়ায় না, লক্ষ্যের দিকে এগিয়েও নিয়ে যায় না। সত্যি বলতে কী আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, একজন প্রোডাক্টিভ মানুষের ব্যস্ততা কম হওয়া উচিত। নিজের ওপর তাকে চাপ কম নিতে হবে। আমাদের ওয়েবসাইটের লোগোতে একজন মানুষের প্রতিকৃতি দেওয়া আছে। সে নিশ্চিন্তে তার চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। প্রশ্ন করতে পারেন, লোগোটি এ রকম কেন করেছি? কারণটি খুবই সহজ। এর মূল কারণ হচ্ছে-সে তার সব কাজ শেষ করে এখন নিশ্চিত মনে বিশ্রাম করছে।
২. প্রোডাক্টিভিটি কোনো ইভেন্ট নয়
আমি সেমিনারে মজা করে বলি- ‘ঘুম থেকে ভোরে উঠে ভাবছেন, ওহ ! আজ আমি খুব সিরিয়াস। আমাকে আজকে প্রোডাক্টিভ হতেই হবে। না, এভাবে প্রোডাক্টিভিটি হয় না। প্রোডাক্টিভিটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার নাম। প্রোডাক্টিভ হতে গেলে সময় লাগে। কার্যকর কিছু করার জন্য প্রতিনিয়ত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলেই বুঝতে পারবেন যে আপনি প্রোডাক্টিভ।
৩. বিনোদনহীনতা মানেই প্রোডাক্টিভিটি নয়
সচরাচরই মানুষ ভেবে থাকে, প্রোডাক্টিভিটি মানেই বিনোদনহীন হতে হবে। টেলিভিশন, ফেসবুক আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা বাদ দিলেই বুঝি প্রোডাক্টিভ হওয়া যায়! না, এমন নয়। প্রোডাক্টিভ হতে হলে সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করা জানতে হবে। আপনাকে জানতে হবে-কখন কঠোর পরিশ্রম করবেন, কখন বিশ্রামে যাবেন। সবকিছুই আপনার সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে ।
৪. সব সময় প্রোডাক্টিভ হতে পারবেন না
ক্রমাগত একটি প্রোডাক্টিভ রুটিন বজায় রাখা একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ। প্রায়শই মানুষ এই চ্যালেঞ্জটির সম্মুখীন হয়। আমাকে অনেকেই এ ব্যাপারে ই-মেইল করে। কষ্ট নিয়ে বলে- সপ্তাহজুড়ে তারা প্রোডাক্টিভ থাকতে পারলেও পরের দুটি সপ্তাহে প্রোডাক্টিভ থাকতে পারেন না। কিছু ঘণ্টার জন্য অতিরিক্ত প্রোডাক্টিভ হলেও কিছুক্ষণ পর তারা চরমভাবে অলস হয়ে পড়েন। এ বিষয়টি ভেবে তারা বেশ চিন্তিত হন। আমি বলি, যদিও একটি নির্দিষ্ট দিনে একটি নির্ধারিত মাত্রায় প্রোডাক্টিভ হওয়ার কিছু উপায় আছে, তার মানে এই নয় পুরো দিন আপনি অব্যাহতভাবে একটি মেশিনের মতো প্রোডাক্টিভ হয়ে খেটে চলবেন। স্বরণ রাখা ভালো, দ্রুত ও চাপে কাজ করার ফলে কিন্তু মেশিনও ভেঙে পড়ে।
ইসলাম ও প্রোডাক্টিভিটি
আধুনিক জীবনে প্রোডাক্টিভিটির ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর প্রাসঙ্গিকতা জানতে হলে আমাদের মূলত তিনটি দিক বিবেচনা করতে হবে। প্রথমত, বুঝতে হবে আদতে কোথা থেকে আধুনিক প্রোডাক্টিভিটির আবির্ভাব ঘটেছে এবং এর জন্য আমাদের জীবনে কী প্রভাব পড়েছে? দ্বিতীয়ত, প্রোডাক্টিভিটির আধুনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলামে কী কী বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, কেন মুসলিম উম্মাহ এক সময়ের অনন্য প্রোডাক্টিভ সভ্যতা হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান যুগে প্রোডাক্টিভ হতে পারছে না।
আধুনিক প্রোডাক্টিভিটির ইতিহাস এবং দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব আধুনিক প্রোডাক্টিভিটির আবির্ভাব ঘটে পাশ্চাত্য সভ্যতা থেকে। শিকড় থেকে যদি দেখি, প্রোডাক্টিভিটির আবির্ভাবের তিনটি মূল কারণ হলো-
১. বিজ্ঞান ও যুক্তি বিস্তারের যুগে নতুন কিছু শেখাতে প্রাধান্য পাওয়াতে মানুষ আরও প্রশ্ন করতে শুরু করে। এতে করে তারা নিজেদের মধ্যে ঘাটতিগুলো চিহ্নিত এবং তা ঠিক করার চেষ্টা করে।
২. চার্চ এবং রাষ্ট্র আলাদা হতে বাধ্য হওয়ার পরেই পাশ্চাত্যের মানুষ ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে এবং তারা সমাজে বেশি সময় দেওয়া শুরু করে ।
৩. শিল্প বিপ্লবের সময় মানুষ টাকার পেছনে ছুটতে শুরু করে-যা পারসুট অব ম্যাটেরিয়ালিজম’ বলে পরিচিত। এতে করে তারা নিজেদের মধ্যে কর্মক্ষমতা বাড়াতে চেষ্টা করে।
এই প্রোডাক্টিভিটির শিকড় জানতে পারলে আধুনিক যুগে তার প্রচলন সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরও স্পষ্ট হবে। ১৭ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ১৮ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন যুক্তি ও জ্ঞান বিস্তৃত হওয়া শুরু হয়, তখন মানুষ সবকিছুই যুক্তি এবং বিজ্ঞানের আয়নাতে দেখা শুরু করে। ধীরে ধীরে ধর্মকে তারা জীবন থেকে দূরে ঠেলতে থাকে। পাশ্চাত্যে বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চিত হয়ে বলতে শুরু করে- মানবজাতির উন্নয়নের জন্য ধর্ম এবং আধ্যাত্মিক চিন্তা-ভাবনা দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে। তারা মানুষকে যুক্তি ব্যবহার করে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে উদাত্ত আহ্বান জানায়। এই নব-আবিষ্কৃত ‘স্বাধীন’ চিন্তাধারা দুনিয়াব্যাপী আলাদা জাতি-রাষ্ট্র এবং পুঁজিবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়।