বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর লিখিত বই ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ এর pdf ফাইল ডাউনলোড করতে নিচে দেওয়া DOWNLOAD বাটনে ক্লিক করুন।
আমরা দেখেছি যে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের মিথ্যাচার ও অপপ্রচার “ইসলামী জঙ্গিবাদ”-কে যেভাবে চিত্রিত করছে তা কখনোই সত্য নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ, কখনো তা মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বাধীকার আদায়ের সংগ্রাম বা আগ্রাসন বিরোধী জিহাদ। তারপরও আমরা দেখি যে, কোনো কোনো মুসলিম ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে সন্ত্রাসে লিপ্ত হচ্ছে। পাশ্চাত্য রাজনীতিবিদ ও গবেষকগণ এদের কর্মকাণ্ডকে “ইসলামী জঙ্গিবাদ” ও “সভ্যতার সংঘাত”-এর পক্ষে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন।
পক্ষান্তরে মুসলিম নেতৃবৃন্দ এদেরকে ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ ও অমুসলিমদের ক্রীড়ানক বলে দাবি করেন। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে, তাদের মধ্যে কেউ অমুসলিমদের ক্রীড়ানক বা এজেন্ট হলেও সাধারণ অনেক যুবক শুধু ইসলামের আবেগেই এদের সাথে যোগ দিয়েছে। ইসলামের কিছু শিক্ষা তারা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে অনেককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। এ সকল বৃিকতি তাত্ত্বিকভাবে আমাদের পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ধর্মীয় অনুভুতি ও আবেগ কখনো অবহেলা, গালি বা কঠোর শাস্তি দিয়ে অবদমিত করা যায় না। ধর্মীয়ভাবে এগুলির বিকৃতি উপলব্ধি করানোই এরূপ প্রবণতা থামানোর অন্যতম পথ।
ইসলামের নামে উগ্রতার উদ্ভবের একটি কারণ ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও বিকৃত ধারণা। এ পথে প্রাচীন ও মধ্যযুগেও ইসলামের নামে সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্ম ও প্রসারের ঘটনা ঘটেছে। এগুলির অন্যতম ছিল প্রথম হিজরী শতকে আলী (রা)-এর শাসনামলে আবির্ভূত খারিজী দল, ৫ম হিজরী শতকে আবির্ভূত বাতিনী হাশাশীন সম্প্রদায় এবং আধুনিক মিসরের “জামাআতুল মুসলিমীন” সংগঠন। জঙ্গি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত মানুষদের কথাবার্তা ও দাবিদাওয়ার সাথে উপর্যুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির বিশ্বাস, তত্ত্ব ও কর্মের অদ্ভুত মিল দেখা যায়। জঙ্গিবাদের প্রেক্ষাপট বুঝতে এ সকল গোষ্ঠীর ইতিহাস, বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে উগ্রতার আবির্ভাবের বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সঃ,ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, “তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় বের হবে, যাদের সালাতের পাশে তোমাদের সালাত তোমাদের কাছেই নগণ্য বলে মনে হবে, যাদের সিয়ামের পাশে তোমাদের সিয়াম তোমাদের কাছেই নগণ্য বলে মনে হবে, যাদের নেককর্মের পাশে তোমাদের কর্ম তোমাদের কাছেই নগণ্য ও অপছন্দনীয় বলে মনে হবে, যারা কুরআন পাঠে রত থাকবে, কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তীর যেমন শিকারের দেহের মধ্যে প্রবেশ করে অন্য দিক দিক দিয়ে বেরিয়ে যায় (তীরের দেহে শিকারকৃত প্রাণীর কোনো মাংস লেগে থাকে না), [ তারা দীনের মধ্যে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে যাবে (তাদের মধ্যে দীনের কিছুই থাকবে না।)
এ অর্থে ১৭ জন সাহাবী থেকে প্রায় ৫০টি পৃথক সুত্রের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদীস প্রমাণ করে যে, বাহ্যিক আকর্ষণীয় ধার্মিকতা, সততা ও ঐকান্তিকতা সত্ত্বেও অনেক মানুষ উগ্রতার কারণে ইসলাম থেকে বিচ্যুত হবে। রাসুলুল্লাহ (S)-এর এ সকল- প্রায় অর্ধশত- হাদীস থেকে আমরা এদের বিভ্রান্তির কারণ ও এদের কিছু বৈশিষ্ট্য জানতে পারি। আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, ইয়ামান থেকে আলী (রা) মাটি মিশ্রিত কিছু স্বর্ণ প্রেরণ করেন। তিনি উক্ত স্বর্ণ ৪ জন নওমুসলিম আরবীয় নেতার মধ্যে বণ্টন করে দেন। তখন বসা চক্ষু, উঁচু গাল, বড় কপাল ও মুণ্ডিত চুল, ফুল খুওয়াইসিরা নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলে,
হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহকে ভয় করুন, আপনি তো বে ইনসাফি করলেন! তিনি বলেন, দুর্ভোগ তোমার! পৃথিবীর বুকে আল্লাহকে ভয় করার সবচেয়ে বড় অধিকার কি আমার নয়? আমি যদি আল্লাহর অবাধ্যতা করি বা বে-ইনসাফি করি তবে আল্লাহর আনুগত্য এবং ন্যায় বিচার আর কে করবে? আল্লাহ আমাকে পৃথিবীবাসীর বিষয়ে বিশ্বস্ত বলে গণ্য করলেন, আর তোমরা আমার বিশ্বস্ততায় আস্থা রাখতে পারছ না! এরপর লোকটি চলে গেল। তখন খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি কি লোকটিকে (রাসুলুল্লাহ (স)-এর প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে ধর্মত্যাগ ও কৃষ্ণরী করার অপরাধে) মৃত্যুদণ্ড প্রদান করব না? তিনি বলেন, না। হয়তবা লোকটি সালাত আদায় করে।
খালিদ (রা) বলেন, কত মুসল্লীই তো আছে যে মুখে যা বলে তার অন্তরে তা নেই। তখন রাসুলুল্লাহ (ঞ) বলেন, আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয় নি যে, আমি মানুষের অন্তর খুঁজে দেখব বা তাদের পেট ফেড়ে দেখব। অতঃপর তিনি গমনরত উক্ত ব্যক্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, এ ব্যক্তির অনুগামীদের মধ্যে এমন একদল মানুষ বের হবে যারা সদাসর্বদা সুন্দর-হৃদয়গ্রাহীভাবে কুরআন তিলাওয়াত করবে, অথচ কুরআন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তাঁর যেমন শিকারের দেহ ভেদ করে বেরিয়ে চলে যায়, এরাও তেমনি ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে চলে যাবে। তারা ইসলামে অনুসারীদের হত্যা করবে এবং প্রতিমা-পাথরের অনুসারীদের ছেড়ে দেবে। আমি যদি তাদেরকে পাই তবে সামুদ সম্প্রদায়কে যেভাবে নির্মূল করা হয়েছিল সেভাবেই আমি তাদেরকে হত্যা করে নির্মূল করব।
মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ফুল খুওয়াইসিরা বা হুরকুস নামক এ ব্যক্তি খারিজীদের গুরুজনদের একজন ছিল। এখানে এ ব্যক্তি ও তার অনুসারীদের বিভ্রান্তির মূল কারণটি প্রতিভাত হয়েছে। তা ছিল ইসলামকে বুঝার ক্ষেত্রে নিজের বুঝকে একমাত্র সঠিক বলে মনে করা এবং এ বুঝের বিপরীত সকলকেই অন্যায়কারী বলে মনে করা। এখানে রাসুলুল্লাহ (সঃ) রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম করেছেন। তিনি সকল যোদ্ধার মধ্যে তা বণ্টন না করে অল্প কয়েকজনকে তা দিয়েছেন। এতে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে মুমিন সহজেই বুঝতে পারেন যে, নিশ্চয় কোনো বিশেষ কারণে আল্লাহর বিশেষ নির্দেশেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) তা করেছেন।
অথবা তিনি রাসুলুল্লাহ -কে এর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু তিনি কখনোই রাসূলুল্লাহ -কে অন্যায়কারী বলে কল্পনা করতে পারেন না বা তাঁকে ‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে পারেন না। কিন্তু এ ব্যক্তি দীন বুঝার ব্যাপারে নিজের জ্ঞানকেই চূড়ান্ত মনে করেছে। সে তার জ্ঞান দিয়ে অনুভব করেছে যে, রাসুলুল্লাহ ইসলামের নির্দেশ লঙ্ঘন করেছেন এবং তৎক্ষণাৎ সে ‘সত্য ও দীন প্রতিষ্ঠা’-র লক্ষ্যে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ -কে আল্লাহকে ভয় করতে ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দিয়েছে!
এখানে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মের একটি বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো, এরা এদের সন্ত্রাসী কর্ম মূলত ‘মুসলিমদের’ বিরুদ্ধে পরিচালিত করে। ‘মুরতাদ’, , ‘কাফির’ ইত্যাদি অভিযোগে এরা মুসলিমদেরকে হত্যা করে। এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন:
“কাফিরদের বিষয়ে যে সকল আয়াত নাযিল হয়েছে এরা সেগুলিকে নিয়ে মুসলিমদের উপর প্রয়োগ করে।” আলী (রা) এবং আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ বলেন,
“এ উম্মাতের মধ্যে (তোমাদের মধ্যে, শেষ যুগে) এমন একটি সম্প্রদায় আগমন করবে যারা বয়সে তরুণ এবং তাদের বুদ্ধিজ্ঞান অপরিপক্কতা ও প্রগভতায় পূর্ণ। মানুষ যত কথা বলে তন্মধ্যে সর্বোত্তম কথা তারা বলবে (সর্বোত্তম মানুষের কথা বলবে, সত্য-ন্যায়ের কথা বলবে)। কিন্তু তারা সত্য, ন্যায় ও ইসলাম থেকে তেমনি ছিটকে বেরিয়ে যাবে, যেমন করে তীর শিকারের দেহ ভেদ করে ছিটকে বেরিয়ে যায়। তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তোমরা যখন যেখানেই তাদেরকে পাবে তখন তাদেরকে হত্যা করবে; কারণ তাদেরকে যারা হত্যা করবে তাদের জন্য কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট পুরস্কার থাকবে।