বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; ইবনে হিশাম রচিত সীরাত গ্রন্থ সীরাতে ইবনে হিশাম এর অংশ বিশেষ বদর যুদ্ধের ইতিহাস এর pdf ফাইল ডাউনলোড করতে নিচে দেওয়া DOWNLOAD বাটনে ক্লিক করুন।
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারলেন যে, আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের নেতৃত্বে কুরাইশদের একটি বিরাট কাফিলা সিরিয়ার দিক থেকে এগিয়ে আসছে। সে কাফিলায় কুরাইশদের বহু সম্পদ এবং বাণিজ্যিক সম্ভার রয়েছে। কাফিলায় মাখরামা ইবনে নওফেল ও আমর ইবনুল ‘আসসহ কুরাইশ বংশোদ্ভূত ৩০ অথবা ৪০ জন লোক রয়েছে। তিনি মুসলমানদেরকে তাদের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, “এটা কুরাইশদের কাফিলা। এতে প্রচুর ধন-সম্পদ রয়েছে। তেমারা ওদিকে চলে যাও। হয়তো আল্লাহ ঐসব সম্পদ তোমাদের হস্তগত করে দেবেন।” মুসলমানরা কাফিলাকে ধরার জন্য যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কেউবা ত্বরিৎ প্রস্তুত হয়ে গেলেন। কেউবা একটু শৈথিল্য দেখালেন এবং দেরী করলেন। কারণ তারা ধারণা করতে পারেননি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছেন।
হিজাযের কাছাকাছি এসে আবু সুফিয়ান ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলো। পথচারী যার সাথেই দেখা হলো, তাকে সে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। কেননা সে মুসলমানদের প্রস্তুতি সম্পর্কে ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। শেষ পর্যন্ত কোন কোন পথচারী তাকে স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিল যে, মুহাম্মাদ তাঁর সহচরদেরকে তোমার ও তোমার কাফিলার ওপর আক্রমণ চালাতে বলেছে। সুতরাং আবু সুফিয়ান সাবধান হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলো। সে দামদাম ইবনে আমর গিফারীকে তৎক্ষণাৎ মজুরীর বিনিময়ে মক্কা পাঠিয়ে দিল। তাকে বলে দিল, সে যেন কুরাইশদের কাছে গিয়ে তাদের ধন সম্পদ নিরাপদে নিয়ে আসার জন্য কিছু অস্ত্রসজ্জিত লোক পাঠাতে অনুরোধ করে এবং মুহাম্মাদ যে তার দলবলসহ তাদেরকে আক্রমণ করতে উদ্যত তা তাদেরকে জানায়। দামদাম খুব দ্রুত মক্কার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল।
দামদাম মক্কা পৌছার তিন দিন আগে আবদুল মুত্তালিব তনয়া আতিকা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি তাঁর ভাই আব্বাসকে ব্যাপারটা জানালেন। বললেন, “ভাই, আজ খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। আমার ভয় হচ্ছে যে, তোমার সম্প্রদায়ের ওপর কোন বিপদ মুসিবত এসে পড়বে। কাজেই আমি তোমাকে যা বলছি কাউকে বলো না।”
আব্বাস বললেন, “তুমি স্বপ্নে কী দেখেছো?” আতিকা বললেন, “দেখলাম, একজন সওয়ার মক্কার পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমিতে এসে নামলো। অতঃপর উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললো, ‘খবরদার, হে কুরাইশগণ! তিন দিনের মধ্যে মৃত্যুর জন্য তৈরী হয়ে যাও।’ তারপর দেখলাম, লোকজন তার পাশে সমবেত হলো। অতঃপর সে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলো এবং লোকজনও তার পেছনে ঢুকলো । সকল লোক যখন তার পাশে জমায়েত হয়েছে, এই সময় সহসা তার উটটি তাকে নিয়ে কা’বার ভেতরে গিয়ে উঠলো। তারপর আবার সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললো, ‘হে কুরাইশগণ, তিন দিনের মধ্যে মৃত্যুর জন্য তৈরী হয়ে যাও, হুঁশিয়ার। অতঃপর তার উট তাকে নিয়ে আবু কুবাইস পর্বত শিখরে আরোহণ করলো। অতঃপর আবার চিৎকার করে একই কথা ঘোষণা করলো। তারপর সেখান থেকে বড় একটা পাথর গড়িয়ে দিল। পাথরটা গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের পাদদেশে পড়তেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল এবং তার কোন না কোন টুকরো মক্কার প্রত্যেক বাড়ীতে গিয়ে পড়লো।
আব্বাস বললেন, এটা একটা গুরুতর স্বপ্ন। তুমি কাউকে এটা বলো না। সম্পূর্ণ গোপন রেখো। এরপর আব্বাস বাইরে বেরুতেই তার বন্ধু ওয়ালীদ ইবনে হবা ইবনে রাবিয়ার সাথে তার দেখা হলো। তিনি তাকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত জানালেন এবং তাকে সাবধান করে দিলেন যেন কাউকে না বলে। ওয়ালীদ ব্যাপারটা তার পিতা উতবাকে জানালো। এভাবে কথাটা সমগ্র মক্কায় রটে গেল। কুরাইশরা সকল মাহফিল ও বৈঠকে এ নিয়ে আলাপ করতে লাগলো।
আব্বাস বলেন, আমি পরদিন কা’বা শরীফ তাওয়াফ করতে গেলাম। আবু জাহল সেখানে কুরাইশ একদল লোকের সাথে আতিকার স্বপ্ন নিয়ে আলাপ করছিলো। আবু জাল আমাকে দেখেই বললো, “আব্বাস, তাওয়াফ শেষ করে এ দিকে এসো।” তাওয়াফ শেষে আমি তাদের কাছে গিয়ে বসলাম। আবু জাহল আমাকে বললো, “হে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র, এই মহিলা- নবী কবে তোমাদেরকে এসব কথা বলেছে?” আমি বললাম, “কিসের কথা?”
আবু জাহল, “আতিকার দেখা সেই স্বপ্নের কথা। আমি বললাম, “সে কী স্বপ্ন দেখেছে?” আবু জাহল, “হে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র, তোমাদের পুরুষরা নবুওয়াতী করতে করতে অবশেষে তোমাদের মহিলারাও দেখছি নবুওয়াতী শুরু করে দিল। আতিকা নাকি স্বপ্নে দেখেছে, কে বলেছে, ‘তিন দিনের মধ্যে তৈরী হয়ে যাও।’ আমরা তোমাদের জন্য তিন দিন অপেক্ষা করবো। যদি কথা সত্য হয় তাহলে তো যা হবার হবে। আর যদি তিন দিন অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও কিছু না ঘটে তাহলে আমরা তোমাদের সম্পর্কে লিখিত ঘোষণা জারী করে দেব যে, আরবে তোমাদের মত মিথ্যাবাদী পরিবার আর নেই। ” আব্বাস বলেন, আবু জাহলের উক্তিতে আমি তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না।
শুধু অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হলাম। বললামঃ আতিকা কোন স্বপ্ন দেখেনি। অতঃপর যার যার কাজে চলে গেলাম। বিকালে আবদুল মুত্তালিব পরিবারের প্রত্যেক মহিলা এক এক করে আমার কাছে এসে বললো, “এই পাপিষ্ঠ খবিসটাকে তোমরা কেন এত সহ্য করছো? সে এতদিন আমাদের পুরুষদের যা ইচ্ছে তাই বলেছে। এখন সে আমাদের নারীদেরকেও যা ইচ্ছে বলতে শুরু করেছে। তুমি এসব শুনছো, অথচ তোমার কোন সম্ভ্রমবোধ জাগছে না।” আমি বললাম, “আল্লাহর কসম, আমি ভীষণ বিব্রতবোধ করছি। আমি বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। তবে ওকে আমি দেখে নেব। আর একবার বলুক, তখন তোমাদের হয়ে যা করা দরকার, তা আমি করবোই।”
আতিকার স্বপ্নের তৃতীয় দিন পর আমি সেখানে গেলাম। আমি তখন রাগে ও ক্ষোভে ফুঁসছি। ভাবছিলাম, বেটার সাথে যে আচরণ করা দরকার ছিল, তা করতে পারিনি। আবার যদি সুযোগ পাই, তবে যা করতে পারিনি তা এবার করে দেখাবো। আমি মসজিদে প্রবেশ করে সেখানে তাকে দেখতে পেলাম। আমি তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম আর অপেক্ষা করতে লাগলাম যে, সেদিন যেসব কথা বলেছে, তার কিছু অংশের পুনরাবৃত্তি করলেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বো। আবু জাহল ছিল হালকা পাতলা গড়নের, কিন্তু তার চাহনি ছিল তীক্ষ্ণ, ভাষা ছিল তীব্র ধারালো। সহসা সে দ্রুত মসজিদের দরজার দিকে এগিয়ে এলো।
আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর অভিশাপ হোক ওর ওপর! ওর কী হয়েছে? ওর সমগ্র সত্তা এমন ভীতসন্ত্রস্ত কেন? তবে কি আমার ভর্ৎসনার ভয়ে? সহসা বুঝতে পারলাম, সে দামদাম ইবনে আমর গিফারীর হাঁকডাক শুনেছে যা আমি তখনো শুনিনি। দামদাম মক্কার মরুভূমিতে এসে তার উটের ওপর বসেই চিৎকার করে বলছে, “হে কুরাইশগণ, মহাবিপদ! মহাবিপদ ! তোমাদের ধন সম্পদ আৰু সুফিয়ানের কাছে। মুহাম্মাদ তার সহচরদেরকে ঐ সম্পদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। মনে হয় তোমরা তা আর রক্ষা করতে পারবে না। সাহায্য করতে অগ্রসর হও! সাহায্য করতে অগ্রসর হও!” গিফারী চিৎকার করে এ কথা বলার আগেই উটের নাক কেটে, হাওদা উল্টিয়ে দিয়ে এবং নিজের জামা ছিঁড়ে একটা তেলেসমাতি কাণ্ড করে ফেলেছে।