বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; আরিফ আজাদ লিখিত বই মা মা মা এবং বাবা এর pdf ফাইল ডাউনলোড করতে নিচে দেওয়া DOWNLOAD বাটনে ক্লিক করুন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুর’আনে আদেশ করেছেন, ‘…তোমরা মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে; তাদের একজন অথবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলো।’ কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের বাবা-মা’রা অধিকাংশ সময়ই আমাদের থেকে যথাযথ মূল্যায়ন পান না। আমরা যখন বড় হই, দুনিয়াকে চষে বেড়াতে শিখি, যখন মায়ের আঁচল কিংবা বাবার হাতের আঙুল ছাড়াই আমরা চলতে পারি, তখন আমরা তাদের ভুলে যাই।
এই বইটি কিছু টুকরো টুকরো গল্প দিয়ে সাজানো। বইয়ের বেশকিছু গল্প শাইখ আবদুল মালিক মুজাহিদের Loving Our Parents বইটি থেকে নেওয়া। আল্লাহ তা’আলা তাকে উত্তম বদলা দান করুন। গল্পগুলো আমাদের চারপাশের সমাজ থেকেই উঠে আসা। পাঠকদের সামনে গল্পগুলো উপস্থিত করার উদ্দেশ্য হলো, বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসাকে আমাদের মধ্যে নতুন করে জাগিয়ে দেওয়া। বাবা-মা’র প্রতি যে সন্তান উদাসীন, যার হৃদয়ে বাবা-মা’র জন্য ভালোবাসার ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যার হৃদয় তাদের প্রতি কঠিন হয়ে পড়েছে, সেই কঠিন হৃদয়, অনুর্বর অন্তর আর বিস্মৃত আত্মাকে জাগিয়ে তোলার জন্যই আমাদের এই ছোট্ট প্রয়াস।
আর যাদের অন্তর বাবা-মা’র জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, তাদেরকেও এই সুসংবাদ জানিয়ে দেওয়া—যা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন। বইটি পড়ে কোনো পাষাণ হৃদয় যদি গলে ওঠে, অন্তঃসারশূন্য কোনো হৃদয়ে যদি ভালোবাসার ফোয়ারা নেমে আসে, যদি কোনো বিস্মৃত অন্তর নতুন করে ভাবনার সুযোগ পায়—তবেই আমাদের কষ্ট সার্থক। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের চেষ্টাগুলো কবুল করুন, আমীন।
সমকালীন প্রকাশন-এর প্রকাশক একদিন আমাকে তাদের একটি বই সম্পাদনা করে দেওয়ার জন্য বললেন। বই সম্পাদনা করা যে কী পরিমাণ ঝামেলার কাজ—সেটা আমি কিছুটা হলেও তখন বুঝতে শিখেছি। একটি বই সম্পাদনা করা একটি নতুন বই লেখার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌলিক একটি বই লেখার চেয়ে সম্পাদনা ঢের শক্ত কাজ; কিন্তু সমস্যা হলো, আমি যে তাদের মুখের উপর ‘না’ বলে বসব, সে উপায়টাও নেই। কারণ, আলোচ্য বইয়ের পেছনে একটি স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বেদনাবিধূর স্মৃতি।
এই বইটি প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল দেশের প্রথিতযশা প্রকাশনী ‘সরোবর প্রকাশন’ থেকে। বইয়ের প্রাথমিক খসড়া দাঁড় করিয়েছিলেন বাক্সের বাইরে এবং তত্ত্ব ছেড়ে জীবনে’র মতো দূর্দান্ত বইয়ের লেখক শরীফ আবু হায়াত অপু ভাই, যিনি আবার পড়ো বইয়ের মতো পাঠকনন্দিত বইয়েরও সম্পাদক। অপু ভাইয়ের সাথে সহযোগী হিসেবে ছিলেন আমাদের সময়কার অন্যতম সুলেখক আরমান ইবন সুলায়মান ভাই। সে যাহোক, এরপর একদিন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল ‘সরোবর প্রকাশন’। মার্কেটে আসা বন্ধ হয়ে গেল পড়ো, ফেরা এবং বাক্সের বাইরে।
একদিন জানতে পারলাম পড়ো এবং ফেরা নতুন করে বাজারে আসছে। কে আনছে? ‘সমকালীন প্রকাশন’। যাক, আলহামদু লিল্লাহ; বইগুলো নতুন করে বাজারে আসছে দেখে আমি বেশ আপ্লুত হলাম।
যে বইটির কথা বলছি, এই বইটির স্বপ্ন দেখেছিল সরোবর পরিবার। বইটির স্বপ্নদ্রষ্টা শরীফ আবু হায়াত অপু ভাই। ‘সরোবর’ এবং ‘অপু ভাই’ তখন আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। এই লোকটিকে দেখতে দেখতেই তো আমরা দ্বীনে এসেছি। এই লোকটির কাছ থেকেই শেখা, দ্বীনে ফেরার পরে কীভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পথ পাড়ি দিতে হয়। অপু ভাই আমাদের জীবনে একটি বাতিঘরের মতো। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু।
দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলাম। মা, মা, মা এবং বাবা আমিই সম্পাদনা করবো। এখনো মনে আছে আমার, এক সন্ধ্যেবেলা অপু ভাইয়ের বাসায় অপু ভাইয়ের সাথে আলাপ করছিলাম। তিনি বললেন, ‘আরিফ, তোমার প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ কত মানুষের কাছে পৌঁছেছে? মানে, কত কপি সেল হয়েছে?’
আমি মিনমিন করে বললাম, ‘হবে হয়তো পঞ্চাশ হাজারের মতো।” ভাইয়া তখন আমার দিকে সুদৃঢ় এক চাহনি দিয়ে বললেন, ‘তোমার বইটি যদি পঞ্চাশ হাজার মানুষের নিকট পৌঁছায়, এই বইটি (মা, মা, মা এবং বাবা) এক লাখ মানুষের নিকট পৌঁছানো উচিত। এটি সেরকম একটি বই।’
ভাইয়া আরও বললেন, ‘এই বইটি পড়ে কাঁদবে না, আবেগাপ্লুত হবে না—এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। আমি যখন এই বইটি নিয়ে কাজ করি, একবার এতই আবেগী হয়ে পড়েছিলাম যে, আমি অফিস থেকে এসে গরম পানি করে আমার আম্মার পা ধুইয়ে দিয়েছিলাম। আমার আম্মা কতজনের কাছে যে করেছে সে গল্প! তিনি বলতেন, ‘আমার অপু আমার পা ধুইয়ে দেয়।’ তো এটি সেরকম একটি বই। বইটি যে একবার পড়বে, তার বাবা-মা যদি বেঁচে থাকে, সে বাবা-মা’র প্রতি এমন অনুগত হয়ে যাবে যে, যা সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি। আর, যাদের বাবা-মা বেঁচে নেই, তারা তাদের বাবা-মা’র জন্য সালাতে দাঁড়িয়ে হুঁহুঁ করে কাঁদবে।’
আমি অপু ভাইয়ের কথাগুলো মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনছিলাম। এতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে যখন অপু ভাই বলেন, তখন সেটা অবশ্যই অবশ্যই ভিন্নরকম কিছু। মা, মা, মা এবং বাবা বইটি সম্পাদনার আগ্রহ আমার তখন আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
এরপরের মাসের কথা। সবে বইটির ফাইল নিয়ে বসলাম। গল্পগুলোর সম্পাদনা করতে গিয়ে এমন হচ্ছিল, আমার চোখের পানিতে ল্যাপটপের কী-বোর্ড ভিজে যাচ্ছে। চোখটা বার বার ঝাপসা হয়ে উঠছে। আমার তখন মনে হচ্ছিল, আমি এক্ষুনি উড়াল দিয়ে আমার মা’র কাছে চলে যাই। গিয়ে তাঁর পা ধরে বসে থাকি। এ যাবৎকালের সমস্ত অন্যায়, অবিচার আর অবাধ্যতার জন্য মাফ চাই…আমার মন চাচ্ছিল, আমি শিশুদের মতো ‘মা মা’ বলে হাউমাউ করে কাঁদি… বাবার বুকে মাথা গুঁজে বলি, ‘বাবা, আমাকে তুমি মাফ করে দিয়ো। কত অবাধ্য ছেলেইনা আমি তোমার…।’
এরপরের দিন অফিসে জানিয়ে দিলাম যে, আমার এক সপ্তাহ ছুটি দরকার। আমি বাড়ি যাবো। আমার ছুটি মঞ্জুর হলো। আমি ঠিক এর পরেরদিনই চট্টগ্রামে চলে গেলাম। সারাটা পথ আমার মন বিষণ্ণ ছিল। একটা বই একটা মানুষের মনকে এতটা নাড়া দিয়ে যেতে পারে, আমি ভাবতেই পারছিলাম না। সেদিন সন্ধ্যেবেলা অপু ভাইয়ের বলা কথাগুলোও মনে পড়ছিল বার বার…
কথা ছিল বইটি ‘বইমেলা ২০১৮ তে প্রকাশিত হবে। সেরকম প্রস্তুতিও ছিল প্রকাশনীর। আমি আমার পক্ষ থেকে সম্পাদিত কপি জমা দিয়ে দিলাম; কিন্তু বেঁকে বসলেন অপু ভাই। বললেন, “খবরদার! কাঁচা কাজ যেন না হয়। এটা কিন্তু এমন একটা বই—যা মানুষ পড়ে অন্যজনকে পড়তে বলবে। কাঁচা কাজ হলে কিন্তু কোনোভাবেই চলবে না। বইমেলাতেই আনতে হবে—এমন কোনো কথা নেই। তাড়াহুড়োর দরকার নেই। তাড়াহুড়ো করা শাইতানের কাজ। আস্তে আস্তে কাজ করো। বেস্ট একটা কাজ হওয়া চাই।’
অপু ভাইয়ের কথা শুনে ‘সমকালীন প্রকাশন’ শিডিউল পিছিয়ে দিল। বইমেলায় আসার কথা থাকলেও বইটা মেলায় আর আসেনি…
আমি বইটি নিয়ে আবার বসলাম। আবার পড়তে গিয়ে দেখলাম, কাজটা আসলেই কাঁচা রয়ে গেছে। সম্পাদনার কাজে এই এক প্যারা। যতবার পড়া হবে, মনে হবে, “আরে, আরও কাজ করা লাগবে। এটা এভাবে না হয়ে, ওভাবে করলে ভালো হতো…।’ ব্যস, বইটি নিয়ে আবারও কাজে লেগে গেলাম। এরপর কেটে গেলো মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই, আগস্ট। ছয়-ছয়টা মাস। দীর্ঘ পরিশ্রম, সমকালীনের সম্পাদক প্যানেলের আপ্রাণ প্রচেষ্টা আর যত্নে অবশেষে বইটি মনের মতো হয়ে উঠল; কিন্তু প্রচ্ছদ…?