বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; আবু তাহের মিসবাহ লিখিত বই এসো আরবি শিখি এর pdf ফাইল ডাউনলোড করতে নিচে দেওয়া DOWNLOAD বাটনে ক্লিক করুন।
আলহামদু লিল্লাহ, ছুম্মা আলহামদু লিল্লাহ, বহু প্রতীক্ষার পর এখন (এসো আরবী শিখি) নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে। কিতাবটি প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিলো আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। যেহেতু এটি আরবী ভাষার প্রাথমিক শিক্ষার একটি গবেষণামূলক কিতাব তাই স্বাভাবিক কারণেই এ দীর্ঘ সময়কালে তাতে বারবার বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে, বরং বলা যায়, নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা এবং অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে কিতাবটি কয়েকবারই নতুনভাবে লিখিত হয়েছে, যাতে ক্রমশ তা সহজ থেকে সহজতর এবং উন্নত থেকে উন্নততর হয়।
বর্তমান সংস্করণটি সেই ধারাবাহিকতারই ফসল। আশা করা যায়, ব্যাপক পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের পর কিতাবটি এখন কিছুটা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছে। শিশু যেমন ধীরে ধীরে শৈশব-কৈশোর পার হয়ে পূর্ণ যুবকে পরিণত হয়, তেমনি আমার এ প্রিয় কিতাবটিও বলা যায়, শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করে এখন একটি পরিণত স্তরে উপনীত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর পাক কালামের পাক যবানের খিদমত করার যে তাওফীক জীবনের এ দীর্ঘ সময় আমাকে দান করেছেন সে জন্য অন্তরের অন্তস্তল থেকে আমি আল্লাহর শোকর আদায় করি। শোকর আলহামদু লিল্লাহ।
এ মুহূর্তটি আমার জন্য পরম আনন্দের মুহূর্ত। এ ধরণের মুহূর্তে ইচ্ছা হয় অতীতের স্মৃতিচারণ করতে। তাই আমিও এখন ফিরে যেতে চাই আমার পিছনের জীবনের আলোচনায়, যাতে প্রিয় পাঠক বুঝতে পারেন, কোন প্রেক্ষাপটে, কীভাবে কিতাবটি অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং কোন কোন পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
আমার বড় সৌভাগ্য এই যে, শিক্ষাজীবনের শৈশবেই আমি এমন একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধান লাভ করেছিলাম যার অন্তরে ছিলো আরবী ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা। প্রদীপ থেকে প্রদীপ যেমন আলো গ্রহণ করে তেমনি হৃদয় থেকে হৃদয় ভালোবাসা গ্রহণ করে। সেই হৃদয়ের পরশ থেকে আমারও হৃদয় আরবী ভাষার প্রতি ভালোবাসা গ্রহণ করেছিলো এবং আরবী ভাষা শেখার একটি ব্যাকুলতা আমাকে আচ্ছন্ন করেছিলো। এ ভালোবাসা ও ব্যাকুলতা যার অবদান তিনি আমার প্রিয় উস্তায হযরত মাওলানা আব্দুল হাই বরিশালী ছাহেব। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
আরবী ভাষা কোরআন ও সুন্নাহর ভাষা। সুতরাং আরবী ভাষায় পূর্ণ পারদর্শিতা রআন-সুন্নাহ এবং শরীয়তের যাবতীয় ইলমের গভীরে প্রবেশ করা কিছুতেই। একজন আরবের জন্য বিষয়টি অপেক্ষাকৃত সহজ হলেও যাদের মুখের ভাষা নয় তাদের জন্য তা খুব কঠিন। এজন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানসম্মত এমন এক পাঠপদ্ধতি অনুসরণ করা, যা শিক্ষার্থীকে অতি সহজে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছে দেবে। কিন্তু আমাদের দরসে নেযামিতে আরবী ভাষা শিক্ষার পদ্ধতিটি এতই ত্রুটিপূর্ণ ছিলো যে, খুব কম ছাত্রই তাতে গ্রহণযোগ্য মান অর্জন করতে পারতো। এ পদ্ধতির প্রথম দুর্বলতা ছিলো এই যে, এখানে ভাষার অঙ্গনে প্রবেশ করা হতো ব্যাকরণ তথা নাহব ছারফের মাধ্যমে, অথচ ভাষাশিক্ষার সবচে’ কার্যকর ও আধুনিকতম পদ্ধতি হলো, ব্যাকরণের প্রত্যক্ষ প্রয়োগ ছাড়া শুধু ব্যবহারিক উপায়ে ভাষার সাধারণ জ্ঞান অর্জন করা, তারপর ব্যাকরণের মাধ্যমে ভাষাজ্ঞানকে সুসংহত করা।
দ্বিতীয়ত শিক্ষার মাধ্যম ছিলো উর্দু ও ফার্সি। তাই আরবী ভাষার আগে দু’টি বিদেশী ভাষার এক অসহনীয় ভার আমাদেরকে বহন করতে হতো, অথচ তখনো মাতৃভাষার সঙ্গেই আমাদের সঠিক পরিচয় হয়ে উঠেনি। এভাবে আমাদের সময় ও শ্রম ব্যয় হতো প্রচুর, কিন্তু ফল হতো খুব কম এবং এক আরবী ভাষার দুর্বলতার কারণে সর্বক্ষেত্রেই তার প্রভাব পড়তো।
আমি তখন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আল্লাহ যদি তাওফীক দান করেন, আমার শিক্ষকজীবনে আমি এ অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করবো, যাতে পরবর্তীরা সঠিক পথে অগ্রসর হতে পারে। তারা যেন সরাসরি মাতৃভাষার মাধ্যমে এবং সহজতম পদ্ধতিতে আরবী ভাষা শিখতে পারে। এ বিষয়ে সর্বপ্রথম আমি প্রেরণা লাভ করি আমার পরম শ্রদ্ধেয় উস্তায হযরত পাহাড়পুরী হুযূরের কাছে। আমার জীবনে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার মাধ্যমরূপে মাতৃভাষার বিকল্প নেই। এখন খুব সাধারণ মনে হবে, কিন্তু সে যুগে সেই পরিবেশে এটা ছিলো এক অসাধারণ ঘটনা যে, তিনি আমাদেরকে রাওযাতুল আদব পড়িয়েছেন, উর্দূতে নয়, বাংলায়।
তারপর পটিয়ার ছাত্রজীবনে যখন হযরত যাওক ছাহেব হুযূরের সান্নিধ্য লাভ করলাম তখনই সত্যিকার অর্থে আরবী ভাষার বিশাল বিস্তৃত অঙ্গনে আমার শুভপ্রবেশ ঘটলো। আরবী ভাষার যা কিছু রুচি ও যাওক আল্লাহ আমাকে দান করেছেন তা যাওক ছাহেবের ছোহবত থেকেই দান করেছেন। আমি যদি যাওক ছাহেবকে না পেতাম তাহলে আমার শিক্ষকজীবন যে বর্তমানের মত হতো না তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আল্লাহ তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
এভাবে আরবি ভাষার খিদমতের একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে আমি ছাত্রজীবন থেকে শিক্ষক জীবনে প্রবেশ করলাম। তখন আমার মনে উদ্যম ছিলো, উদ্দীপনা ছিল, আর ছিলো অস্থিরতা ও ব্যাকুলতা। আমি জানতাম, আমাকে কিছু কিন্তু জানতাম না, কীভাবে ও কোন পথে আমাকে এগুতে হবে? আমি দিকে তাকাই, কিন্তু আমার সামনে শুধু জমাটবাঁধা কুয়াশা। তবু শুরু হলো শিক্ষকজীবনের যাত্রা, ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাদরাসা থেকে। এ যাত্রা ছিলো একেবারে পাথেয় ছাড়া। তবু দেখা গেলো, অকূল দরিয়ায় হাবুডুবু খাওয়া ছাত্ররা আমাকেই ‘তৃণখণ্ড’রূপে গ্রহণ করলো এবং তাদেরও কিছু না কিছু উপকার হলো। আজ সাতাশ বছর পর এখনো আমি আমার শিক্ষকতার সেই শৈশবের ছাত্রদের ভালোবাসায় সিক্ত। এটা এক চিরন্তন সত্য যে, তুমি যদি কিছু দাও তাহলে কিছু না কিছু অবশ্যই পাবে।
মানুষ যখন নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে প্রার্থনা জানায় তখন আল্লাহ গায়ব থেকে সাহায্য করেন। যাত্রাবাড়ী মাদরাসার খুব গরীব একটি কুতুবখানা ছিলো। সেখানেই আমি রাত্রিযাপন করতাম। একরাতে সেই কুতুবখানায় অপ্রত্যাশিতভাবে আমি আরবী ভাষা শিক্ষার একটি প্রাথমিক কিতাব পেলাম। নাম, আলক্বিরাআতুল ওয়াযিহাহ। লেখক দারুল উলুম দেওবন্দের আরবী আদবের উস্তায মাওলানা ওয়াহীদুয্যামান কীরানবী (রহ)। সে রাত আমার ভোর হয়েছিলো ঐ কিতাবের মাঝে নিমগ্ন অবস্থায়। কিতাবটি যেন পথের সামনের সব কুয়াশা দূর করে দিলো এবং পথের পূর্ণ মানচিত্র আমার সামনে মেলে ধরলো। আমি পেয়ে গেলাম আমার পথের পাথেয় এবং মনযিলের সন্ধান। এভাবেই বান্দাকে আল্লাহ গায়ব থেকে সাহায্য করেন। বান্দা অবশ্য সবসময় তা উপলব্ধি করতে পারে না, বরং তার দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যায় কারণ ও কার্যকারণের গোলকধাঁধায়।
আরবী ভাষা শিক্ষার ফল ও ফুল আহরণের জন্য কিতাবটিকে আমি বৃক্ষরূপে গ্রহণ করতে পারতাম। সহজ মনে করে সাধারণত সেটাই আমরা করে থাকি। কিন্তু এখানেও আল্লাহ আমাকে সাহায্য করলেন। আমি আমার ভিতর থেকে একটি আওয়ায পেলাম, কিতাবটিকে তুমি বৃক্ষরূপে নয়, বীজরূপে গ্রহণ করো। আমি তাই করলাম। সেই সুন্দর বীজটি থেকেই জন্ম লাভ করেছে আমার প্রিয় কিতাব ‘এসো আরবী শিখি’। বীজ ও বৃক্ষের মাঝে যে পার্থক্য, উভয় কিতাবের মাঝেও সেই পার্থক্য।
বৃক্ষের কাজ বীজ দ্বারা হয় না আবার বীজ ছাড়া বৃক্ষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় তুমি পাবে বৃক্ষের কাছে, কিন্তু বীজের অবদান কখনো ভূলে যেতে পারো না। আজ ‘এসো আরবী শিখি’ নামের যে সবুজ বৃক্ষের সুশীতল ভাষার ফল ও ফুল আমি আহরণ করছি এবং বিতরণ করছি, তার কীরানবীর ঐ কিতাবের বীজটি থেকে। সুতরাং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। জীবনে তাঁকে আমি একবারই দেখেছি। দারুল উলূম দেওবন্দের ‘ছাদসালা’ উপলক্ষে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমি তাঁর খিদমতে তখনকার এসো আরবী শিখি কিতাবটি কৃতজ্ঞতাসহ পেশ করেছিলাম এবং মানুষ হিসাবে তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ত্বের পরিচয় পেয়েছিলাম। কবরে আল্লাহ তাঁকে শান্তিতে রাখুন।