বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; ড. মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান লিখিত বই ইমাম বুখারী রহঃ এর pdf ফাইল ডাউনলোড করতে নিচে দেওয়া DOWNLOAD বাটনে ক্লিক করুন।
হাদীস শাস্ত্রে বিশ্ব-সম্রাট উপাধিতে ভূষিত ইমাম বুখারী (র)-এর আসল নাম ছিল মুহাম্মদ। কুনিয়াতের দিক দিয়ে তিনি পরিচিত ছিলেন আবু আবদুল্লাহ্ নামে। তাঁর পিতার নাম ছিল ইসমাইল। তিনি ৪র্থ তাব্কার নামকরা হাদীসবেত্তা ছিলেন। দাদার নাম ইব্রাহীম ও পরদাদার নাম ছিল মুগীরা-বিন-বারদো। ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওয়াল, শুক্রবার জুমআর নামাযের বাদ তিনি বুখারা শহরে ভূমিষ্ঠ হন।
বুখারা শহর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত উজবেকিস্তানে অবস্থিত। এককালে এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী নগরী ছিল। মুসলিম শাসনাধীনে আসার আগে এটি সামানিয়া রাজাদের রাজধানী ছিল।
ইমাম বুখারীর পরদাদা বা প্রপিতামহ মুগীরা বুখারার তদানীন্তন শাসনকর্তা ইয়ামান জা’ফীর কাছে পবিত্র ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বুখারায় অবস্থান করতে থাকেন। এজন্যেই এই বংশকে জা’ফী বংশ বলা হয়। কারণ তখনকার দিনে ইয়ামানে কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে জা’ফী তাঁকে নিজ বংশ পরিচয়ে আশ্রয় দিতেন।
তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। পরদাদা মুগীরা পারস্য হতে খোরাসানের অন্তর্গত বুখারা নামক শহরে এসে বসবাস আরম্ভ করেন। বাল্যকালেই তাঁর পিতা মারা যান। তিনি স্বীয় মাতার নিকটই প্রতিপালিত হন। আহমদ নামে তাঁর এক বড় ভাই ছিলেন। আগেই বলেছি, তাঁর পিতাও একজন নামকরা মুহাদ্দিস ছিলেন। ইমাম মালেক, হাম্মাদ এবং উবনুল মুবারক প্রমুখ বিশিষ্ট হাদীসবেত্তার প্রিয় শিষ্য হিসাবে বহুদিন ধরে তিনি হাদীস শিক্ষা করেন। ইমাম বুখারী স্বয়ং তাঁর ‘তারীখে-কবীর’ নামক গ্রন্থে স্বীয় পিতার বিস্তৃত জীবনী লিপিবদ্ধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে স্বীয় পিতার জ্ঞান-গরিমা ও অন্যান্য মনীষার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি যথারীতি গৌরব প্রকাশ করেন। যোগ্যতম পিতার যোগ্যতম সন্তানই বটে।
বাল্যকাল হতেই ইমাম বুখারী (র)-এর উপর আল্লাহ্র বিশেষ রহমতের দৃষ্টির নিদর্শন দেখা যাচ্ছিল। ইমাম বুখারী বাল্যাবস্থায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মাতা ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার আশায় সর্বদাই কায়মনোবাক্যে আল্লাহ্র দরবারে প্রার্থনা করতেন। আল্লাহ্ তাঁর মাতার দোআ কবুল করেন, ফলে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। কথিত আছে যে, এই স্নেহময়ী মাতা স্বপ্নযোগে নবী ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ্ (আ)-কে দেখতে পেয়েছিলেন।
হযরত ইব্রাহীম (আ) স্বপ্নে তাঁর মাতাকে সম্বোধন করে বললেন- “হে উম্মে- মোহাম্মদ! তুমি শুভ সংবাদ গ্রহণ কর। তোমার শিশুপুত্র দৃষ্টিশক্তিহীন হওয়ার কারণে যেহেতু তুমি মনে-প্রাণে অত্যন্ত আঘাত পেয়েছ; তাই তোমার কাতর কণ্ঠের রোদন ও বিলাপধ্বনি শুনে আল্লাহ্ পাক দয়া পরবশ হয়েছেন এবং তোমার প্রাণাধিক পুত্রের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন।” আল্লাহ্ কী অপার মহিমা! এই স্নেহময়ী মা অতি সকালে শয্যাত্যাগ করে ওযু নামাযের পর যখন ছেলের চোখের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তখন দেখতে পেলেন সত্যি সত্যিই ছেলের চক্ষু সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করেছে। এই অভাবিতপূর্ব দৃশ্যে তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। আনন্দ গদ্গদ্ চিত্তে তিনি আল্লাহর সমীপে অজস্র শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন।
দৃষ্টিশক্তি লাভের পর তাঁর চক্ষের জ্যোতি এত তীক্ষ্ণ হয়েছিল যে, পরবর্তী জীবনে চাঁদের আলোতে তিনি লেখাপড়ার কাজ অনায়াসে সমাধা করতে পারতেন। তাঁর সংকলিত “আততারিখুল কবীর” নামক বিরাট ঐতিহাসিক গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তিনি চাঁদের নির্মল আলোকেই লিখে শেষ করেন। ইমাম বুখারীর এই হস্তলিখিত অমূল্য গ্রন্থখানি ভারতের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা শামসুল হক্ আযিমাবাদীর (মৃঃ ১৩২৯ হিঃ; ১৯১১ খৃঃ) ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে।
পিতার অকাল মৃত্যুতে শিশু পুত্রের লালন-পালন, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতি যাবতীয় বিষয়ের দায়িত্বভার তাঁর পুণ্যাত্মা জননীর উপর ন্যস্ত হলো। মুহাম্মদ-বিন-ইসমাইল বুখারী (র) মাতৃক্রোড়ে প্রতিপালিত হয়ে তাঁরই উপযুক্ত তত্ত্বাবধানে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। অসাধারণ ধী-শক্তিসম্পন্ন এই প্রতিভাসমুজ্জ্বল বালক অত্যল্পকাল মধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে পবিত্র হাদীস শাস্ত্র ও ইসলাম সম্পর্কীয় অন্যান্য বিষয় শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করেন। এই হাদীস শাস্ত্রের পবিত্র শিক্ষার ব্যাপক অনুশীলন করতে গিয়ে তিনি সিরিয়া, মিসর, আলজাযায়ির, বসূরা, কুফা, হিজায প্রভৃতি দেশ-বিদেশের আনাচে-কানাচে অনন্যমনে পরিভ্রমণ করতে থাকেন।
এ সময় থেকে তিনি অন্তরে হাদীস শাস্ত্রের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ অনুভব করেন এবং সনদসহ হাদীস কণ্ঠস্থ করতে অসাধারণ স্মৃতি-শক্তির পরিচয় দিয়ে সকলকে বিস্মিত ও স্তম্ভিত করেন। মুহাম্মদ ইবনে আবি হাতিম বররাক বলেন, “আমি বুখারীকে বলতে শুনেছি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই আমি হাদীস কণ্ঠস্থ করার প্রেরণা পাই।” আরও বলেন, “আমি ইমাম বুখারীকে জিজ্ঞাসা করে অবগত হই যে, তাঁর বয়স যখন দশ বছর তখনই তাঁর কণ্ঠস্থ করার স্পৃহা বলবতী হয়েছিল।’ এ সময়ে তিনি অন্যান্য শিক্ষার্থীর সাথে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণের নিকট হাদীস চর্চা আরম্ভ করেন।” হাদীস শিক্ষার সূচনাতেই এ বিদ্যায় তিনি যে অপূর্ব পারদর্শিতার পরিচয় দেন তার একটি নযীর পাঠকবর্গের সামনে উপস্থিত করছি।
বুখারা নগরীতে এ সময় খ্যাতনামা মুহাদ্দিস আল্লামা দাখেলী অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর শিক্ষাগারটি যেমন জাঁকজমক ও আড়ম্বরপূর্ণ ছিল, তেমনি তার যশ ও প্রভাব চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল। একদিন তিনি যখন তাঁর ছাত্রমণ্ডলীকে পাঠ দিচ্ছিলেন, সে সময় ইমাম বুখারী হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হন এবং দরসে যোগদান করেন। আল্লামা দাখেলী একটি হাদীসের সনদ এভাবে বর্ণনা করেন— -“সুফিয়ান আবু জুবায়ের হতে, তিনি ইব্রাহিম হতে রেওয়ায়েত করেছেন।” সঙ্গে সঙ্গে ইমাম বুখারী প্রতিবাদ করে বলেন-“আবু জুবায়ের ইব্রাহিম হতে রেওয়ায়েত করেননি।” একটি অপরিচিত ও অল্পবয়স্ক বালকের এইরূপ প্রতিবাদে আল্লামা দাখেলী বিচলিত ও চমকিত হয়ে উঠেন ও রুক্ষভাবে দু’-চারটি শক্ত কথা শুনিয়ে দেন। কিন্তু বালক বুখারী কখনো দমবার পাত্র ছিলেন না।
তিনি অতি বিনম্র বচনে আরয করলেন : “মহাত্মন! যদি আপনার নিকট আসল বর্ণনালিপি (মুসাবিদা) থাকে তা’হলে মেহেরবাণী করে আপনি তা দেখুন।” আল্লামা দাখেলী তৎক্ষণাৎ গৃহে গিয়ে আসল বর্ণনালিপি উত্তমরূপে দেখে নিজের ভ্রমের কথা বুঝতে পারলেন। তিনি ইমাম বুখারীকে উক্ত হাদীস সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে ইমাম সাহেব উত্তর দেন, – “আবু জুবায়ের নয় বরং আদির পুত্র জোবায়ের ইব্রাহিম হতে রেওয়ায়েত করেছেন।” আল্লামা দাখেলী নতশিরে এ বর্ণনার বিশুদ্ধতা স্বীকার করে নেন। অতঃপর তিনি তখনি তাঁর সম্মুখস্থ কিতাবেও ভুল সংশোধন করে নেন ও বলেন : “বৎস! তুমি যা বলেছ তাই ঠিক, আমিই ভুল করেছিলাম।” এ সময় বালক বুখারীর বয়স মাত্র এগার বছর।
এরূপ অল্প বয়সে তিনি কেবল হাদীস সঠিকভাবে কণ্ঠস্থ করে রাখার ব্যাপারেই যে ঐকান্তিক আগ্রহ ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিলেন তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে তিনি সহীহ ও গায়ের সহীহ হাদীসের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে হাদীসের দোষ-ত্রুটি যাচাই করার দুরূহ কাজেও প্রবল ঔৎসুক্য ও পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। হাদীসের রাবিগণের পুংখানুপুংখ অবস্থা, তাঁদের সাধুতা ও বিশ্বস্ততা, সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতা, স্মৃতিশক্তি ও বর্ণনা ক্ষমতা, চরিত্র ও ব্যবহারিক জীবন, বাসস্থান ও শিক্ষা-দীক্ষার স্থান, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ এবং রাবিগণের পারস্পরিক সাক্ষাৎ প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট বিষয়েও তথ্য অবগত হওয়ার জন্য অন্তরে এক আকুল আগ্রহ ও প্রবল প্রেরণা অনুভব করেন।
ইমাম সাহেবের শিক্ষাযুগের প্রারম্ভকালে বুখারার বিদ্যালয়সমূহে যে সমস্ত প্রতিভাবান ও খ্যাতনামা মুহাদ্দিস বিরাজমান ছিলেন তন্মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আল্লামা মোহাম্মদ ইবনে সালাম বয়কন্দী, ইউছুফ বয়কন্দী, আবদুল্লাহ ইবনে মোহাম্মদ খুসনদী, ইব্রাহিম ইবনে আল-আশ-আস্। ইমাম সাহেব এ সব মনীষীর নিকট হতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন।